Search This Blog ( এই ব্লগটি অনুসন্ধান করুন )

Thursday, 14 February 2019

মীরণের সমাধি :

👉 বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন ইতিহাস প্রসিদ্ধ জায়গা গুলোর গৌরবময় কাহিনী বরাবরই আমাদের মনকে নাড়া দেয় । বাংলার নবাবি আমলের ইতিহাসে প্রায় অনেকটা অংশ জুড়েই রয়েছে ভালোবাসা , লালসা , বিশ্বাসঘাতকতা ও রণণ্মত্ব যুদ্ধের ঝনঝনানি । ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে অজস্র প্রাচীন কাহিনী, তার কতটুকু কাল্পনিক বা কতটুকু সত্য সে কথা ইতিহাসবিদরাই বলতে পারবেন। এমনই এক ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পেলাম বাংলার এক রাজপুত্রের কথা। ইতিহাসের পাতায় তিনি চিরকালই বিশ্বাসঘাতকের পুত্র হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে এসেছেন। ইতিহাস খ্যাত সেই রাজপুত্রই হলেন মীরজাফর পুত্র মীর সাদেক আলি খান, যিনি মীর মীরণ নামেই সমধিক পরিচিত। রহস্যময় তাঁর মৃত্যু কাহিনীর মতই তাঁর সমাধি যেন আজও রহস্যের চাদরে ঢাকা আছে প্রাচীন বাংলার রাজধানী রাজমহলের বুকে। রহস্য রহস্য গন্ধ থাকলে মন যেন ছুটে যেতে চায় সেই অতীতের সময়কালে । আমার মন যেন তখন রহস্যের স্বাদ নিতে সওয়ার হয়েছে কাল্পনিক টাইম মেশিনে । গন্তব্য সেই রোমাঞ্চকর অষ্টাদশ শতাব্দী। কল্পনার দেশে, যেন ফুটে উঠল পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী সেই রোমহর্ষক দিনগুলোর কথা। সময়টা ছিল ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে জুন। ব্রিটিশ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ সৈন্য বাহিনী নিয়ে এসে উঠেছেন মুর্শিদাবাদ শহরের কাছাকাছি মাদাপুরে , এমন সময় জগতশেঠ পত্র দ্বারা ক্লাইভকে জানালেন যে এখন মুর্শিদাবাদ শহরে প্রবেশ করলে আপনার প্রাণ সংশয় হতে পারে কারন মীরজাফর পুত্র মীরণ সৈন্য বাহিনী নিয়ে শহরের প্রবেশদ্বারে আপনার গতিরোধ করবার জন্য দাড়িয়ে আছেন । এই খবর খুব দ্রুততার সাথে মীরজাফরের কাছে পৌছে গেলে মীরজাফর বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং প্রতিরোধ তুলে নেওয়ার জন্য মীরণকে আদেশ দিলেন। এই আদেশে মীরণ কর্ণপাত না করায় মীরজাফর ছুটে গেলেন স্ত্রী শাহ্ খানুমের কাছে এবং ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করতে থাকলেন । বেগম শাহ্ খানুম নিজ পুত্রের অনিষ্টের কথা চিন্তা করে তাড়াতাড়ি তাকে পত্র দ্বারা ডেকে পাঠালেন এবং পত্রে লিখলেন, যে তিনি যদি ফিরে না আসেন তবে তার মা অন্তঃপুর ছেড়ে সেখানে হাজির হবেন । মায়ের অনুরোধে মিরণ ফিরে আসেন প্রাসাদে এবং এরপরে ব্রিটিশরা রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে শহরে প্রবেশ করেন। এদিকে খবর রটে গেল যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ধরা পড়েছেন রাজমহলে। ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের ৩০ শে জুন অথবা অন্য মতে ১লা জুলাই সিরাজউদ্দৌলাকে মুর্শিদাবাদে আনা হলো । ততক্ষনে সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে মীরজাফর হীরাঝিল প্রাসাদের মসনদে আসীন হয়েছেন এবং বিচারের জন্য সিরাজউদ্দৌলাকে হীরাঝিল প্রাসাদ এর দরবারে নিয়ে যাওয়া হলো। সিরাজউদ্দৌলা কাতর স্বরে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানালেন মীরজাফর এর কাছে কিন্তু মীরজাফর ও দরবারে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ এই ব্যাপারে মতামত দিতে অসমর্থ হলেন এবং এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে বলে মীরণের নেতৃত্বে সিরাজউদ্দৌলাকে কারাগারে প্রেরণ করলেন । কাল বিলম্ব না করে মসনদের ভবিষ্যত্ উত্তরাধিকারী মীরণ তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছকে ফেললেন । ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের দুসরা জুলাই গভীর রাত্রে মিরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলা কে হত্যা করলেন। এরপরে মসনদের উত্তরাধিকারীর পথ নিষ্কণ্টক করতে মীরণ একে একে হত্যা করলেন সিরাজউদ্দৌলা ছোট ভাই মির্জা মেহেদী ও আরো অনেককে । এছাড়াও নবাব আলীবর্দী খানের পরিবারের মহিলা সদস্যদের গ্রেফতার করে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে পাঠিয়ে দেওয়া হল। নবাব পরিবারের মহিলাদের ভাগ্যে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে এলো । এরপর নিকটস্থ ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেল। মীরণ ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদের সেনাধ্যক্ষ কে বারবার আদেশ দিতে থাকলেন নবাব পরিবারের মহিলাদের হত্যা করার জন্য কিন্তু তিনি এই কাজ করতে অস্বীকার করলে মীরণ নিজেই তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করে ফেললেন। অবশেষে নবাব পরিবারের মহিলাদের মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে আনার নাম করে নৌকায় চাপানো হল এবং বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে ঘষেটি বেগম ও আমিনা বেগম কে হত্যা করা হলো। অবশ্য ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপে বেগম লুৎফুন্নিসা , শরফুন্নিসা ও রাজকন্যা উম্মে জোহরা রক্ষা পেলেন। এর মধ্যেই নবাব সৈন্য যুবরাজ মীরণের নেতৃত্বে ও ব্রিটিশ সৈন্য ব্রিটিশ সেনাপতি কোল্ড এর নেতৃত্বে যৌথভাবে রাজমহলের কাছাকাছি আজিমাবাদে ( বর্তমান পাটনা ) যুদ্ধে গিয়েছেন দিল্লির বাদশাহ শাহ আলম ও পূর্নিয়ার শাসক খাদেম হোসেনের যৌথ বাহিনীর মোকাবিলা করতে । সৈন্য সংখ্যা কম থাকায় ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন নক্স এর নেতৃত্বে একটি সৈন্য বাহিনী, রাজমহলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করতে বাধ্য হন নবাব মীর জাফর। ক্যাপ্টেন নক্স খুব দ্রুততার সাথে রাজমহলে পৌছালে সম্রাট শাহ আলমের যৌথ বাহিনী পশ্চাদগমন করতে বাধ্য হন। এমতাবস্থায় আজিমাবাদে অবস্থানকালে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দের ২ রা জুলাই রাত্রে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সৈন্যবাহিনী তাবুতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ভাবি নবাব মীরণ তার বড় তাবুতে আশ্রয় নেন এবং ঝড়ের তীব্রতা এতটাই ছিল যে মীরণের বড় তাঁবু ক্ষতিগ্রস্ত হয় । এরপর মীরণ বাধ্য হয়ে অপেক্ষাকৃত একটু ছোট তাবুতে আশ্রয় নেন এবং ঘটে যায় সেই অলৌকিক কান্ড । প্রচন্ড আওয়াজের সাথে মীরণের তাঁবুতে বজ্রপাত হয় এবং এই বজ্রপাতেই মীরণের মৃত্যু হয় । অনেকে অবশ্য মনে করেন ব্রিটিশরাই মীরণকে হত্যা করেছিল। তার মধ্যে স্বাধীনতার চিন্তা বলবতী হওয়ায় ব্রিটিশদের চক্রান্তেই তাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল। এছাড়াও মীরণের শরীরের গুলির চিহ্ন নবাব মীরজাফরের কাছে গোপন রাখতেই মৃতদেহ মুর্শিদাবাদে না নিয়ে এসে রাজমহলে সমাধিস্থ করা হয়। যাই হোক সকাল হলে খুব দ্রুততার সাথে মীরণের মৃতদেহ গঙ্গা পার করে রাজমহলে সমাধি দেওয়া হয়। এই রোমাঞ্চকর কাহিনীতে আমি যেন সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিলাম। সম্বিত্ ফিরতেই মনে এলো মীরণের সমাধির বর্তমান করুণ অবস্থার কথা । মন যেন কোন মতেই আর এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের সাথে ঘটে চলা অবহেলার সাথে মিত্রতায় রাজি নয়। রাজমহল বাস স্টপ থেকে পশ্চিম দিকে সোজা এক রাস্তা গিয়েছে তালঝারী পর্যন্ত । এই রাস্তাতেই রাজমহল বাস স্টপ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে মহাজনটুলির গোশালা নামক জায়গায় রাস্তার দক্ষিণ দিকে এক আমবাগানের মধ্যে সেই রাজপুত্রের সমাধি চোখে পড়ে । সমাধি দেখেই যেন চমকে উঠতে হয় । একি ....... ? রাজপুত্রের সমাধি জঙ্গলে আবৃত ......? বিধাতার কি নির্মম পরিহাস, একদিন এই রাজপুত্রের রোষানলে পড়ে প্রাণ হারাতে হয়েছিল নবাব আলিবর্দি খানের পরিবারের অনেককেই আর আজকে তিনিই বিধাতার রোষানলে । পূর্বে আমবাগান সম্বলিত এই সমাধি ক্ষেত্রটি পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে প্রাচীর দ্বারা ঘেরা ছিল যার এখন কোন চিহ্নই নেই, এমনকি সমাধিতে কোন প্রস্তর ফলকও নেই । যিনি একসময় দেশের ভবিষ্যৎ নিজের হাতে লিখতে চেয়েছিলেন আজ দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার সমাধিই খুজে পায়না। সত্যিই এ এক করুণ পরিণতি । এ যেন বিষাদে একান্তে গুমরে গুমরে কেঁদে চলেছেন এক বিশ্বাসঘাতকের অন্তজ ........ ।

No comments: