💢বহরমপুর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে ৩৪ নং জাতীয় সড়কের পাশে মানকরা গ্রাম। মানকরা রেলগেটের সামান্য দক্ষিণ - পশ্চিমে এই ভাষ্করদহ অবস্থিত। সে অনেক আগের কথা। সময়টা প্রায় ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ই মে । খুঁর্শিদাবাদ শহরের ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে ডাহাপাড়া। বর্গী নেতা ভাষ্কর পণ্ডিত সেখনে উপস্থিত । ডাহাপাড়া বাজার পুড়িয়ে দিয়ে ভাগীরথী নদী পেরিয়ে পূর্ব পাড়ে রাজধানী শহরে ঢুকে পড়ে বর্গীরা ৷ সারাদিন ধরে লুঠতরাজ চলে রাজধানী মুর্শিদাবাদে । মহিমাপুরে জগৎশেঠদের গদী থেকে দু কোটি টাকা লুঠ করে । আলিবর্দী আসার আগেই তারা পালিয়ে যায় । অবস্থাপন্ন ধনী পরিবারের মানুষেরা রাজধানী মুর্শিদাবাদে থাকতে বিপন্ন বোধ করতে লাগলো । বিশেষ করে যাদের হারানাের ভয় বেশি , বর্গীদের লক্ষ্য রাজধানী শহরের সেই ধনী ব্যাক্তিরা । তাই শহর মুর্শিদাবাদ ছেড়ে মফস্বল কলকাতাই তাদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠলো । অজগ্রাম কলকাতা শহরে পরিণত হওয়ার সুযোপ পেল বর্গীদর সৌজন্যে । অতঃপর বর্গী দমনের জন্য আলিবর্দী দিল্লির সাহায্য প্ৰার্থনা করলেন । সম্রাট তখন সফদরজঙ্গকে দায়িত্ব দিলেন বিহার রক্ষার । চতুর সফদরজঙ্গ প্ৰচার করে দিলেন সম্রাট তাঁকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবেদারির সনদ দিয়েছেন । আলিবর্দী বুঝলেন অবস্থা সুবিধার নয় । দূত দ্বারা চিঠি পাঠালেন নবাব । জানালেন বর্গী দমনে আমার সৈন্যবলই যথেষ্ট, আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই । ও দিকে সম্রাটের ডাকে সাড়া দিয়ে পেশোয়া বালাজী রাও বিহারের উদেশ্যে যাত্রা শুরু করেছেন । খবর পেয়ে সফদরজঙ্গ পিছু হটতে শুরু করলেন … । কারণ তাঁর সঙ্গে বালাজি রাওয়ের সম্পর্ক “অহিনকুলে’ । সফদরজঙ্গের থেকে আলিবর্দী রক্ষা পেলেন । পুনরায় নতুন সমস্যা উপস্থিত হলো নবাবের কাছে । বাংলা হয়ে উঠলো দুই পরস্পর বিরোধী মারাঠা শক্তির রণাঙ্গন । একদিকে পেশোয়া বালাজী রাও অন্যদিকে রঘুজী ভোঁসলে । আলিবর্দী হাত মেলালেন পেশোয়া বালাজী রাওয়ের সঙ্গে দাউদপুরে । ১৭৪৩, ৩১ মার্চ , আলিবর্দী বার্ষিক চৌথ আর সৈন্য বাহিনীর খরচ বাবদ ২২ লক্ষ টাকা দিলেন । পেলেন বালাজীর বন্ধুত্ব । প্রতিশ্রুতি দিলেন বালাজি রাও যে বাংলা , বিহার ও উড়িষ্যা থেকে বর্গী নেতা রঘুজী ভৌসলেকে উংখাত করে ছাড়বেন। আলিবর্দি খাঁ ও বালাজী রাও যৌথ ভাবে আক্রমণ শুরু করলেন রঘুজীকে । রঘুজী তখন দাই হাটের কাছাকাছি ৷ যৌথ আক্রমণের খবর পেয়ে বীরভূমের দিকে পালিয়ে গেলেন রঘুজী । মারাঠা বাহিনীর গতি আলিবর্দীর বাহিনীর থেকে অনেক বেশি ছিল , বালাজী রাও তাই বাধ্য হয়েই আলিবর্দীকে জানান রঘুজীকে ধরতে গেলে আমার একক বাহিনী নিয়ে তাড়া করতে হবে । আলিবর্দী বালাজীর প্রস্তাব মেনে নিলেন । কাটোয়ায় ফিরে এলেন নবাব । বালাজী ধাওয়া করলেন রঘুজীকে, কিছুদিন পর বালাজী দূত মারফত নবাবকে সংবাদ দিলেন যে ওড়িষার সম্বলপুরের দিকে চলে গিয়েছেন রঘুজী । হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন আলিবর্দি । বালাজী রাও দেশে ফিরতে না ফিরতেই রঘুজী মেদিনীপুরে পৌঁছে দূত দ্বারা চৌথ দাবি করলেন ।
দীর্ঘদিন যুদ্ধে ব্যস্ত নবাব আলিবর্দি আর পেরে উঠছিলেন না । সৈন্যরা রণ ক্লান্ত। সেনাপতিরাও চাইছিলেন বিশ্রাম। লড়াই করে বর্গীদের প্রতিহত করা সম্ভব নয়, আলিবর্দি এটা বুঝতে পেরেছিলেন। ফাঁদ পেতে শিকার ধরতে হবে। ভাষ্কর পণ্ডিতকে বন্দী করার পরিকল্পনা করে দূত পাঠালেন তাঁর কছে। দূত জানালো আপনারা চান চৌথ আর নবাব চান শান্তি। আপনারা দুজনে মিলে বসে সন্ধি করে নিন । ভাষ্কর পণ্ডিত এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি আলিভাইকে পাঠালেন, সন্ধির ব্যপারে কথা বলতে নবাবের সঙ্গে। নবাব আলিভাইকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। মিষ্টি কথা ও সুন্দর সুন্দর উপহারে তার মন ভরিয়ে দিলেন । নবাব তাঁদের সকলকে ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে মানকরায় আসতে
নিমন্ত্রণ করলেন। বললেন সন্ধির কথা সবাই মিলে বসে হবে । আপনাদের সব শর্তই আমি মানব , আমার দাবি শুধু বাংলায় শান্তি বিরাজ করুক। বিষয়টি আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য নবাব তাঁর প্রধান সেনাপতি মুস্তাফা খাঁ ও দেওয়ান জানকীরামকে ভাষ্কর পণ্ডিতের শিবিরে পাঠালেন। ভাষ্কর পণ্ডিত তখন ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে দিগনগর শিবিরে ছিল। দিগনগর হচ্ছে কাটোয়া ও বর্ধমানের মধ্যবর্তী এক যায়গা । তাঁরা দুজন ভাষ্কর পণ্ডিতের শিবিরে গিয়ে কোরাণ ও গঙ্গাজল-তুলসী ছুঁয়ে শপথ নিয়ে কথা দিয়ে এলেন যে মারাঠাদের সঙ্গে বিশ্বাসহীনতার কোনো কাজ হবে না।
ভাষ্কর পণ্ডিত তাঁর ২২ জন সেনাপতিদের নিয়ে আলোচনায় বসলেন । ২১ জন সেনাপতি সন্ধির পক্ষে মত দিলেন । একমাত্র রঘুজী গাইকোয়াড সন্ধির পক্ষে ছিলেন না । সংখ্যাগরিষ্ঠের মত নিয়ে ভাষ্কর ২২ জন সেনাপতি ও ১০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য সহ ভাগীরথী পার হয়ে পলাশীতে এসে তাঁবু ফেললেন। দিনটা ছিল ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে মার্চ । পলাশী থেকে ভাষ্কর পণ্ডিত মানকরায় এলেন । ১০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের দায়িত্ব রঘুজী গাইকোয়াডের উপর দিয়ে ২১ জন সেনাপতি সহ ভাষ্কর , আলিবর্দির শিবিরে প্রবেশ করলেন। শিবির থেকে বেশ কিছু দূরে মাঠের মধ্যে খানে তাঁর সৈন্যদের অবস্থান। আলিবর্দি বড়ো বড়ো তাবু খাটিয়ে হাতি , ঘোড়া , উঁট ইত্যাদি নানারকম দামী সামগ্রী রঙিন পতাকা দিয়ে এমন সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছেন যে দেখে বোঝার উপায় নেই এটা একটা মরণফাঁদ । ভাষ্কর পণ্ডিতরা যে তাবুতে প্রবেশ করেছিল সেটা ছিল ডবল পর্দা দেওয়া তাবু। দুই পর্দার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল আলিবর্দির বাছাই করা ঘাতক বাহিনী । হাতে তাদের ধারালো মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্র। তাবুর ভিতরে ঢুকে বা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে ওখানে সৈন্যদের অবস্থান রয়েছে। ভাষ্কর পণ্ডিতরা যে শিবিরে ঢুকেছিল সেটা ছিল দরবার শিবির । আকারে ছিল বিরাট। নবাবের আদেশে ভাষ্কর পণ্ডিতরা দরবার শিবিরে প্রবেশ করার পর কাপড়ের ভারী দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। নবাব পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তাঁর সেনাপতিদের আদেশ দিলেন যে এবার তোমরা তোমাদের কাজ শুরু করো , এক জনও যেন বাদ না পড়ে । এই বলে তিনি তাবু থেকে বেড়িয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁর সেনাপতি এসে খবর দিলেন যে নবাবের হুকুম পালন হয়েছে। নবাবের নির্দেশে বাকি তাবু থেকে অসংখ্য সৈন্য বের হয়ে তাড়া করলো দূরে মাঠের মধ্যে দাড়িয়ে থাকা মারাঠা সৈন্যদের। রঘুজী গাইকোয়াড যেন এর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আগেই বুঝতে পেরেছিলেন আলিবর্দির চাল । তাই সন্ধির পক্ষে মত দেয়নি। নবাব সৈন্যদের তাড়া খেয়ে তীর গতিতে ১০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন রঘুজী গাইকোয়াড। নবাব বাহিনী তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারলেন না। অতঃপর নবাব আলিবর্দি খানের নির্দেশে ভাষ্কর পণ্ডিত সহ ২১ জন মারাঠা সেনাপতির মৃতদেহ নিকটস্থ একটি জলাশয় বা দহতে ফেলে দেওয়া হয়। অখ্যাত একটি জলাশয় ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল। এই ভাষ্কর পণ্ডিতের নামেই নামকরণ হয়ে গেল ভাষ্করদহ নামে । ইতিহাসের অসংখ্য স্মৃতি ও ভাষ্কর পণ্ডিত সহ ২১ জন সেনাপতির করুণ আর্তনাদের জ্বলন্ত স্বাক্ষী হয়ে আজও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এই ভাষ্করদহ।
তথ্যসূত্র : মুর্শিদাবাদ থেকে পলাশী ও মহারাষ্ট্র পুরাণ।
No comments:
Post a Comment